কল্লোলিনী কলকাতা। আর কলকাতা মানেই পেটুক বাঙালি। খাইদ্যাখাইদ্যের সঙ্গে তো আমাদের সম্পর্কটা অনেকটা জল আর হাঁসের মতো। ছোটবেলা থেকেই মা-কাকিমাদের বলতে শুনছি, “আমার ছেলেটা একদম খেতে চায় না৷” আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘‘আমার ছেলের খাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, যা দেবে তাই খেয়ে নেবে।’’ অনেক সময় খেতে না চাইলে মা বলেছে, ‘‘এখন যদি না খাস তাহলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে খাবি কী করে? তখন তো সবাই বলবে, এ বাবা, ছেলেটা খেতে জানে না!’’

যাই হোক, সেসব তো ছিল ছোটবেলার কথা। দেখতে দেখতে সময় অনেকটা পেরিয়েছে। বড় হয়েছি। চাকরি করছি। আমার মায়ের চোখেও ছানি পড়েছে। কিন্তু মা সেই আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। আগে স্কুল থেকে আসার পর টেবিলে যেমন খাবারটা সাজানো থাকত, ঠিক এখনও তেমনই থাকে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে এখনও অন্তত দশবার শুধু খাওয়ার কথা শুনতে হয়। এক এক সময় বিরক্ত লাগে। বলে বসি, ‘‘তোমাদের কি খাওয়া ছাড়া আর কোনও টপিক নেই?’’ মা উত্তর দেয়, ‘‘আগে আমার বয়সে পৌঁছ, তারপর বুঝবি।’’
ভাবছেন এগুলো কেন বলছি? আমার শহরের অলিগলি, রাজপথ পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছি আমরা। ল্যান্ডলাইন ছেড়ে হাতে এখন স্মার্টফোন এসেছে। এখন এসি বাস চড়ছে আমার শহর। কিন্তু এই দ্রুত বদলে চলা শহরে কিছু জিনিস আজও একই রয়ে গিয়েছে।
যদি খাবারের কথায় আসি, তাহলে এটা অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে বাঙালিকে সবচেয়ে বেশি চেনা যায় খাওয়ার টেবিলে। তবে শুধুমাত্র ভাত, ডাল, আলুভাজা, বেগুনভাজা, রুই-কাতলা, ইলিশ-চিংড়িতে নয়। নিজেদের এই চিরাচরিত খাবারের মেনুর সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খাবারকে আমরা নিজেদের পাতে জায়গা করে দিয়েছি। আর বিদেশি খাবারের মধ্যে বলতে গেলে অবশ্যই চাইনিজ। বলা বাহুল্য, আজকের জেনারেশনে চাইনিজ খাবার পছন্দ করে অনেকেই। মেনল্যান্ড চায়নার মিক্সড হাক্কা নুডলস থেকে পাড়ার স্টিফেন দা’র মোমো। সবটাই মোটামুটি চেখে দেখা হয়ে গিয়েছে।
তবু তার বাইরেও এখনও কিছু ঠিকানা আছে, যেখানে গেলে ঘটে আস্বাদের রকমফের৷ যদি কম দামে খাঁটি চাইনিজ খাবার খেতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই চলে যেতে হবে চায়না টাউন বা টেরিটি বাজার। মধ্য কলকাতার এই ছোট্ট অঞ্চলটিতে কয়েক প্রজন্ম যাবৎ চিনা মানুষজনের বসবাসই বেশি। সকাল সকাল চাইনিজ খাবার দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে চাইলে, আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে এখানে। তবে সকাল নটার মধ্যে। কারণ, এই বাজারটি খোলা থাকে ভোর পাঁচটা থেকে সকাল নটা পর্যন্ত। এখানে আপনি চিকেন মোমো, ফিশ ডাম্পলিং, ফ্রায়েড মোমো দিয়ে সহজেই সেরে ফেলতে পারেন আপনার ব্রেকফাস্ট। এছাড়াও এখানেই পাবেন রাইস পুডিং, হ্যামসিং পাং, ফিশ বল, মিট বল, প্যান কেক, প্রন ওয়েফার্স সহ আরও অনেক কিছু। দাম খুবই কম। এক প্লেট চিকেন মোমো আপনি পেতে পারেন মাত্র তিরিশ টাকায়, আবার ফিস ডাম্পলিংয়ের মতো সুস্বাদু অথচ দামী ডিশ মেলে ৮০ টাকায়। তবে এই বাজারের মূল আকর্ষণ রবিবার। সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে সেদিন। কেনাবেচার পরিমাণও থাকে বেশি।
এই অঞ্চলে চিনাদের বসবাস প্রায় ২০০ বছর। আর এই বাজারের বয়সও ১০০ বছরের উপর। কিন্তু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই বাজারের ঐতিহ্য। যারা এই বাজারটি পরিচালনা করেন প্রতি সকালে, তাঁরা প্রত্যেকেই প্রবীণ। ৭৫-এরও বেশি বয়সী আকুং জানান, “২০ বছর আগেও খুব বিক্রি হত। কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই চলে গিয়েছে। এখন শুধুমাত্র ৫০০ জনের মতো চিনা সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন এই এলাকায়।” তাঁর মুখ থেকেই জানতে পারি, এই অঞ্চলের মানুষজনের আর একটি প্রধান ব্যবসা ছিল জুতোর ব্যবসা। জুতো তৈরি করে এই বাজারেই তাঁরা বিক্রি করতেন। লাভও হত প্রচুর। সংসারও চলত খুব ভালোভাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে ছন্দপতন। বড় বড় ব্র্যান্ডের জুতো ছেড়ে আজ আর কেউ চিনা জুতো পরে না। তাই ধীরে ধীরে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। খাবার বিক্রি করে আর কটা টাকাই বা হয়?
জিজ্ঞাসা করলাম, “অন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন না কেন?” কিছুক্ষণ হাসলেন সেই বৃদ্ধ। বললেন, “আর কিছু জানলে তো করব। ছেলেরা কেউ বম্বে, কেউ হায়দরাবাদ। তারা টাকা পাঠালে তাতে সংসার চলে।”
আজ অনেকেরই অবস্থা করুণ। ঠিক করে দুবেলা খাওয়াও জোটে না। ভোটের বাজারে দর নেই, অতএব তেমন কেউই সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। সপ্তাহশেষে রোজগার, ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। তবু সব সময় মুখে হাসি। নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে দিব্যি রয়েছেন। বলা বাহুল্য সৌজন্যে মাও সে তুংয়ের ‘রেড বুক’ নয়, অবশ্য অবশ্যই লাওৎজে-র তাও তে চিং৷